loader
Top-header/

স্প্যানিশ ফ্লু: ১০০ বছর পূর্বের এক ভয়ংকর মহামারী

18 Jun 2020

যুগে যুগে বহু মহামারী এই বিশ্বে প্রলয় সৃষ্টি করে চলেছে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে সাধারণত প্রায় ১০০

বছর পর পর ভয়ংকর কোন মহামারী ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে প্রায় পুরো পৃথিবীতে এবং কেড়ে নেয় কোটি

কোটি প্রাণ। ১৭২০ সালের বিউবোনিক প্লেগ মহামারী, ১৮২০ সালের কলেরা মহামারী, ১৯১৮-১৯২০ সালের

স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী, ২০২০ সালের করোনা ভাইরাস মহামারী এই বিষয়টিকেই সমর্থন করে।এদের মাঝে

কোটি কোটি মানুষের যমদূত হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই ১৯১৮ সালে এই রোগ পৃথিবীজুড়ে ছড়াতে শুরু করে। এটি ছিল মূলত

প্রলয়ংকরী একটি প্রাণঘাতী ভাইরাসঘটিত রোগ, যা বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে আক্রান্ত করেছিল।

আর কেড়ে নিয়েছিল ২ কোটি মতান্তরে ৫ কোটি মতান্তরে ১০ কোটি মানুষের প্রাণ। এখন সমগ্র পৃথিবীতে

যেমন করোনা ভাইরাস প্রলয় সৃষ্টি করে চলেছে, আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর পূর্বে এই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস

দাপিয়ে বেড়িয়েছিল কোটি কোটি প্রাণ সংহারে। এটিই ইতিহাসের বিখ্যাত সেই স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মানুষ নিহত হওয়ার ক্ষত দূর হতে না হতেই পৃথিবীজুড়ে শুরু হয়েছিল যেন

নতুন এই যুদ্ধ। পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করতে চেয়েছিল এই মরণব্যাধি। নতুন ধরনের সেই ইনফ্লুয়েঞ্জাকে

প্রথম শনাক্ত করা হয়েছিল ১৯১৮ সালের মার্চ মাসে এক মার্কিন সৈনিকের শরীরে। ততদিনে যুদ্ধক্ষেত্র

থেকে সৈন্যরা ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল। আগস্ট মাস আসতেই ঝড়ের গতিতে ছড়াতে শুরু

করেছিল সেই মহামারী। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে আক্রমণ হলেও পৃথিবীর

কোনো দেশই রক্ষা পায়নি এই ভাইরাসের ছোবল থেকে। ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামে সেই মহামারীর কবলে পরের দুই

বছরে পুরো পৃথিবীতে পাঁচ কোটি মানুষ মারা যায়। তবে কোনো কোনো গবেষকের মতে মৃতের এ সংখ্যা

কোনোভাবেই ১০ কোটির কম হবে না।তবে স্প্যানিশ ফ্লুকেই এখন পর্যন্ত মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড়

মহামারী বলা হয়ে থাকে। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক এবং বিধ্বংসী রূপে আবির্ভূত হয়েছিল এই

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসটি। বলা হয় যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যতজন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, স্প্যানিশ ফ্লুতে তার

চেয়েও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও যত প্রাণহানি হয়েছিল, তার চেয়েও বেশি

প্রাণহানি ঘটেছিল স্প্যানিশ ফ্লুতে। আবার এমনও বলা হয় যে দুই বিশ্বযুদ্ধে যত প্রাণ গেছে, তার চেয়েও

বেশি প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল এই স্প্যানিশ ফ্লু।

স্প্যানিশ ফ্লুর আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে, এটি সাধারণত তরুণদের মধ্যে সংক্রমিত হতো। দেখা গেছে, ২০

থেকে ৪০ বছর বয়সীরাই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে

নানারকম যন্ত্রণাদায়ক উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। এসব উপসর্গের মধ্যে ছিল মাথাব্যথা, জ্বর, ক্লান্তি

ইত্যাদি। প্রাথমিকভাবে এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে অনেকেই ভাবতেন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। ভাবা

হতো, এগুলো সাধারণ মাইগ্রেন বা অতিরিক্ত কাজের ক্লান্তি থেকে দেখা দিয়েছে। কিন্তু যখন রোগীর ত্বক

ধীরে ধীরে নীল বর্ণ ধারণ করতে শুরু করে তখনই টনক নড়ে। স্প্যানিশ ফ্লুর পরের পর্যায়টি হলো ফুসফুসে

রক্তপাত। কখনো কখনো এটা এত শক্তিশালী ছিল যে, সংক্রমণের পরের দিন এ রোগে আক্রান্ত বেশিরভাগই

মারা যেতেন।

সূত্রপাত: ধারণা করা হয়, স্প্যানিশ ফ্লু প্রথম শনাক্ত করা হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য-

পশ্চিমাঞ্চলের ছোট্ট শহর কানসাসের একটি সামরিক ক্যাম্পে। জানা যায়, ১৯১৮ সালের ১১ মার্চ সকালে

রান্নাঘরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এক সৈন্য। কিন্তু সন্ধ্যা গড়াতে না গড়াতেই ওই ক্যাম্পের শত শত সৈন্য ও


কর্মকর্তা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক সপ্তাহের মধ্যেই এটি আমেরিকার অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে।

একসময় স্পেন, ফ্রান্স এবং ইতালিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশেও এই মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময়ে

সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকত ০.১ শতাংশ। কিন্তু স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের

মৃত্যুর হার ছিল সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি।


আরেকটি ব্যাপার হলো ওই ভাইরাসটির সর্বগ্রাহী দিক। কারণ এটি সবার জন্যই সমান হুমকির ছিল। ধনী-

গরিব নির্বিশেষে সবাইকে এ রোগ আক্রান্ত করেছিল। দরিদ্র কিংবা সমৃদ্ধ সব অঞ্চলেই এ রোগটির বিস্তার

ঘটেছিল। ট্রেন, জাহাজ এবং অন্যান্য যানবাহন বিশ্বব্যাপী এ রোগের দ্রুত বিস্তারে অবদান রেখেছিল।

নামকরণ: রোগটির সূত্রপাত স্পেনে না হলেও এটি স্প্যানিশ ফ্লু হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার প্রধান কারণ ছিল

মূলত অন্য দেশগুলোর সামরিক সেন্সরশিপ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ওই সময়টিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক

দেশই মহামারী সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশে সংবাদপত্রগুলোকে নিষিদ্ধ করেছিল। এর কারণ ছিল প্রথমত বিরোধী

শক্তিদের কাছে নিজের দুর্বলতাকে প্রকাশ না করা, দ্বিতীয়ত সাধারণ মানুষের মধ্যে যেন ভীতি ছড়িয়ে না পড়ে।

এছাড়া সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যেতে পারে এমন ভাবনা থেকেও এ রোগের বিস্তার সম্পর্কে দেশগুলো অনেক

কিছু গোপন করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নথিপত্রে রোগটিকে ইনফ্লুয়েঞ্জার পরিবর্তে শুধু ফ্লু হিসেবে

উল্লেখ করা হয়েছিল। অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কোনো পক্ষেই ছিল না স্পেন। ফলে দেশটি যুদ্ধে

অংশগ্রহণ করেনি। নিরপেক্ষ এ দেশটিতে যখন ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে তখন দেশটির সংবাদপত্রগুলোতে

ফলাও করে এটির খবর প্রকাশ করা হয়। তাই স্প্যানিশ গণমাধ্যমে প্রকাশিত অজানা এ রোগ সম্পর্কে জানতে

পেরে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ। সেই সময়টিতে স্পেনের রাজা অষ্টম আলফনসো এবং

প্রধানমন্ত্রীসহ দেশটির বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

রোগের বিস্তার : স্প্যানিশ ফ্লু বিস্তারের তিনটি ধাপ ছিল। প্রথম ধাপে, রোগটি ১৯১৮ সালের মার্চ থেকে

জুলাই পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এ সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। যদিও সবচেয়ে বেশি

প্রাণহানি ঘটেছিল দ্বিতীয় ধাপে। দ্বিতীয় ধাপে রোগটি সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিস্তার লাভ

করেছিল। তৃতীয় ধাপটি শুরু হয় ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবং শেষ হয় এপ্রিল মাসে। এ ধাপে মহামারীর কবলে

পড়ে মানুষের মৃত্যুহার হ্রাস পায়।

সারা বিশ্বে প্রায় আড়াই বছর ধরে স্প্যানিশ ফ্লু রাজত্ব করেছিল। বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর

জনসংখ্যার ২ থেকে ৫ শতাংশ মানুষ এ মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে মার্কিন

যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় পৌনে সাত লাখ ও ফ্রান্সে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। ব্রিটেনে মারা যায় দুই

লাখেরও বেশি মানুষ। এ মহামারীতে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি হয়েছিল এশিয়ায় অবস্থিত দেশগুলোর। এর মধ্যে

শুধু ভারতেই প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। এ সংখ্যাটিকে কেউ কেউ আরও বেশি বলে দাবি

করেন। এছাড়া জাপানে ৩ লাখ ৯০ হাজার ও ইন্দোনেশিয়ায় ১৫ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ

ব্রাজিলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রদ্রিগেজ আলভেজসহ দেশটিতে প্রায় তিন লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে।

গবেষকরা দাবি করেন, এই ভাইরাসে সর্বমোট মৃতের সংখ্যা কোনোভাবেই ১০ কোটির কম নয়। এ সম্পর্কে পিট

ডেভিস তার ‘দ্য ডেভিলস ফ্লু’ বইটিতে দাবি করেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিংশ শতকের শুরুর দিকে

বিশ্বব্যাপী যে অব্যবস্থাপনা ছিল তাতে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে স্প্যানিশ ফ্লুতে মৃত মানুষদের সঠিক

পরিসংখ্যান তৈরি করা সম্ভব হয়নি। জরিপের বাইরে থেকে যায় অসংখ্য জনগোষ্ঠী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,

স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে উত্তর আমেরিকায় বসবাসকারী এস্কিমোদের ৬০ শতাংশই মারা গিয়েছিল। এই

মহামারীর ফলে আফ্রিকার বেশকিছু আদিবাসী গোষ্ঠী সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়। কিছু কিছু শহরের

জনসংখ্যা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গিয়েছিল। ফিজি দ্বীপপুঞ্জের জনসংখ্যা কমেছিল প্রায় ১৪ শতাংশ আর

পশ্চিমা সামোয়ার জনসংখ্যা হ্রাস পায় প্রায় ২২ শতাংশ।


স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর ক্ষেত্রে অ্যালামোন ডেল্টা দ্বীপে অবস্থিত বেলেমের শহরকে আসলে ভাগ্যবান না

বলে কোনো উপায় নেই। কারণ এই ফ্লুর কোনো প্রভাব সেখানে পড়েনি। এই ফ্লু সবচেয়ে গুরুতরভাবে যুদ্ধরত

সেনাবাহিনীগুলোকে আঘাত করেছিল। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ শতাংশ নাবিক এবং ৩৫ শতাংশ

সৈন্যের মধ্যে এ রোগের সংক্রমণ ঘটেছিল।


জনজীবনে প্রভাব : জানা যায়, অনেক অঞ্চলেই স্প্যানিশ ফ্লুর কারণে স্থানীয় চিকিৎসকরা নিশ্চিহ্ন হয়ে

যায়। কারণ এই ফ্লুতে আক্রান্ত রোগীদের সঙ্গে তারাই প্রথম যোগাযোগ স্থাপন করতেন। ফলে তারাও

অবধারিতভাবে এ মহামারীর কবলে পড়ত। এমনও দেখা গেছে, কোনো একটি শহরে স্প্যানিশ ফ্লু মারাত্মক

আকার ধারণ করলেও সেখানে কোনো চিকিৎসকের অস্তিত্ব ছিল না। এই মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে এতবেশি

মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল যে, বিভিন্ন এলাকায় মৃত শত শত মানুষকে গণকবর দেওয়া হয়েছিল। আবার কিছু

কিছু মৃতদেহ দিন কিংবা সপ্তাহ ধরে রাস্তায় কিংবা ঘরের মধ্যে পড়ে ছিল। এসব মৃতদেহ পচে-গলে

পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছিল। প্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুর কারণে অনেক অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে

অনাথ হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বের অনেক দেশে, রেল যোগাযোগ প্রায় সম্পূর্ণরূপে থেমে যায়। দেখা যেত, ট্রেন যে

চালাবে সেই চালকই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে কিংবা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। অনেক দেশেই

বিদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। কিছু এলাকায় গির্জার মতো ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোও সারা বছরের জন্য

বন্ধ করে দেওয়া হয়। জানা যায়, একটি আমেরিকান শহরে মহামারীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন করে

হ্যান্ডশেক নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কেও এ মহামারী দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। দেখা যেত, একটি দোকানে কোনো

মানুষ কেনাকাটা করতে গেলে তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়েই তার বাজারের তালিকা এবং অর্থ একটি ঝুড়ির মধ্যে

রাখত, তারপর দোকানি সেই অনুযায়ী বিভিন্ন পণ্য ছোট্ট একটি খুপরির মতো জানালা দিয়ে ক্রেতাকে দিতেন। এ

ক্ষেত্রে কানাডার উদাহরণটিই দেওয়া যাক। দেশটিতে তুলনামূলক কম মানুষের মৃত্যু হলেও পরিস্থিতি জটিল

আকার ধারণ করেছিল। এখানে স্প্যানিশ ফ্লুর প্রথম আক্রমণ হয় মন্ট্রিলে ১৯১৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। এক

সপ্তাহের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। দেশটিতে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের প্রাণহানী ঘটেছিল। সদ্যসমাপ্ত

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যেখানে প্রতিদিন গড়ে একশ কানাডীয় প্রাণ হারিয়েছে, সেখানে ১৯১৮ সালের অক্টোবর

মাসে দেশটিতে প্রতিদিন মারা গেছে প্রায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ। মন্ট্রিলে মৃতের সংখ্যা এত বিশাল ছিল

যে, ট্রলিকারে লাশবোঝাই করে শহর থেকে সরাতে হয়েছিল।

কানাডার ইতিহাসে ওই সংক্রমণ ছিল একটি বিশেষ অধ্যায়। ইতিহাসে অন্যান্য সব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে

নিয়ে ২০০১ সালে টরন্টোর ডাবলডে প্রকাশনী থেকে অসাধারণ একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। ‘স্টোরি অব অ্যা

নেশন : ডিফাইনিং মোমেন্টস ইন আওয়ার হিস্ট্রি’ শিরোনামের সেই গ্রন্থে কানাডার বরেণ্য সাহিত্যিক

টিমোথি ফিন্ডলের একটি প্রবন্ধ আছে। কানাডার ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত নিয়ে মার্গারেট

অ্যাটউড, আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েল, ডিয়োন ব্যান্ড, ডেভিড ম্যাকফারলেন বা টমাস কিঙের মতো প্রথিতযশা

লেখকরা লিখলেও টিমোথি লিখেছেন স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ে। জানিয়েছেন কীভাবে যুদ্ধে তার কাকা মারা গেলেন; আর

কীভাবে ফ্লুতে তার মামা মারা যান। কীভাবে ওই মৃত্যুর স্মৃতি পুরো পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে

চলেছে।

কানাডার শহরে শহরে ঘোষণা দিয়ে স্কুল, কলেজ, থিয়েটার, চার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সর্বত্র

জনাসমাগম নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। চতুর্দিকে আতঙ্কময় সেই সময়ে এমনও দেখা গেছে একজন সকালে

অফিসে গেছেন, কিন্তু বিকেলে বাড়িতে ফিরতে পারেননি-অফিসেই জ্বর এবং মৃত্যু। এমনকি মৃত মানুষদের

শবযাত্রায় ঘনিষ্ঠজন ছাড়া অন্যদের না থাকার জন্যও পরামর্শ দেওয়া হতো।

১৯১৮ সালের ১১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের কানসাসের একটি সামরিক ঘাঁটিতে মহামারীটির সূত্রপাতের পর

দ্রুতগতিতে তা সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। পরে আগস্টের দিকে এর প্রকোপ কিছুটা কমে এলেও সেপ্টেম্বর থেকে


দ্বিতীয়বার শুরু হয় এবং সেবারের পরিস্থিতি প্রথমবারের চেয়েও মারাত্মক ছিল। সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ শুধু

ম্যাসাচুসেটসেই প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিল। এ রোগের বিস্তার থামানোর জন্য

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরের সমস্ত গির্জা, স্কুল, থিয়েটার এবং অন্যান্য জনসমাগমের জায়গাগুলো বন্ধ

করে দেওয়া হয়। ওরিগন, উটাহ এর মতো রাজ্যগুলোতে ডাক্তারের সুস্থতার সার্টিফিকেট ছাড়া বাইরের মানুষ

প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আলাস্কার বন্দরটি বন্ধ করে দেন গভর্নর। শুধু তাই নয়, মহামারী

মোকাবিলায় তিনি একটি রক্ষী দলও গঠন করেন। বলা হয়ে থাকে ১৯১৮ সালের শেষদিকে মহামারীতে প্রায় ৫৭

হাজার মার্কিন সৈন্য মারা যায়, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মৃত্যুহারের চেয়ে দশগুণ বেশি ছিল। মহামারীর প্রভাবে

যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের গড় আয়ুর সূচকে ১২ বছর কমে গিয়েছিল।

স্প্যানিশ ফ্লুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল আফ্রিকায়। এ মহাদেশে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি

হয়েছিল জাম্বিয়ার। দেশটির প্রায় ২১ শতাংশ মানুষই এ মহামারীতে প্রাণ হারিয়েছিল। মোট জনসংখ্যার ১০.২

শতাংশ মারা গিয়েছিল জিম্বাবুয়েতে। তানজানিয়ায় মারা গিয়েছিল ৮.১ শতাংশ মানুষ। আর আফ্রিকা মহাদেশে

সবচেয়ে কম মানুষের মৃত্যু হয়েছিল মিসরে, মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ।বৈজ্ঞানিকভাবে নিশ্চিত করা না হলেও

অনেকে বিশ্বাস করেন, স্প্যানিশ ফ্লু ছড়িয়েছিল চীন থেকে। ধারণা করা হয়, এ মহামারীতে দেশটির প্রায় ৯৫

লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।

আজ শত বছর পরে এসে চীনের উহান শহর থেকে সূত্রপাত হওয়া করোনা ভাইরাস পৃথিবী জুড়ে তাণ্ডবলীলা

চালিয়ে যাচ্ছে। শত বছর পর পর আগমন ঘটা এসব মহামারী কি আসলে প্রকৃতির কোন অভিশাপ?


ডা.হিমেল ঘোষ

এমবিবিএস(ঢাকা মেডিকেল কলেজ) , বিসিএস( স্বাস্থ্য),

মেডিকেল অফিসার,

উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ডুমুরিয়া,খুলনা।

Latest Blogs

Professional Certification Courses on Health Sector Management

Professional certification courses on health sector management are arranged by Bangladesh Doctors' Foundation in collaboration...

চিকিৎসকদের নিয়ে লিডারশীপ এক্সেলেন্সী কর্মশালা

১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাজধানীর বুয়েট গ্রাজুয়েট ক্লাবে দিনব্যাপী চিকিৎসকদের নিয়ে দেশে সর্বপ্রথম বারের মতো লিডারশীপ এক্সেলেন্সি...